এক ঝলকে বুঝে নিন উপজাত দ্রব্য কী?: সংজ্ঞা, প্রকার, ও ব্যবহার
আমার এই লেখায় আমি উপজাত দ্রব্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। উপজাত দ্রব্য বলতে কী বোঝায়, এর কী কী প্রকারভেদ আছে, কোন কোন জিনিস উপজাত দ্রব্যের উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, উপজাত দ্রব্যের কী কী ব্যবহার আছে এবং এর সুবিধা ও অসুবিধা কী কী – এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আলোচনা করবো আমি। এই লেখাটি পড়ে আপনারা উপজাত দ্রব্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাবেন এবং শিল্পকারখানাগুলোতে উপজাত দ্রব্য ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কেও জানতে পারবেন।
উপজাত দ্রব্য কী?
আমাদের রোজকার জীবনে যেসব পণ্য বা দ্রব্য আমরা ব্যবহার করি, সেগুলো তৈরি করতে গিয়ে কাঁচামাল ছাড়াও আরেক ধরনের উপকরণ ব্যবহার করা হয়, যাকে উপজাত দ্রব্য বলে। এগুলো মূল পণ্য তৈরির সময় অবশিষ্ট থাকে এবং কখনো কখনো এগুলোকে আবার অন্য পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, কাগজ তৈরির সময় কাঠের গুঁড়ি থেকে সেলুলোজ তন্তু আলাদা করার পরে যে অবশিষ্টাংশ থাকে তাকে কাঠের গুঁড়ি বলা হয়। এই কাঠের গুঁড়িগুলোকে আবার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অন্য একটি উদাহরণ হলো চিনি তৈরির সময় গাছের রস থেকে চিনি নিষ্কাশনের পরে যে অবশিষ্টাংশ থাকে তাকে গুড় বলা হয়। এই গুড়কে আবার মিষ্টিজাতীয় খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। সুতরাং, উপজাত দ্রব্য হলো সেইসব উপকরণ যা মূল পণ্য তৈরির সময় অবশিষ্ট থাকে এবং যা অন্য পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
উপজাত দ্রব্যের সংজ্ঞা
মূলত উপজাত দ্রব্য হল যেকোনো প্রাথমিক পণ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়ার সময় প্রাপ্ত দ্বিতীয়িক পণ্য। এগুলি মূল পণ্যের উৎপাদন প্রক্রিয়ার অপরিহার্য অংশ নয়, তবে প্রাথমিক পণ্য তৈরির সময় সহ-উৎপাদন হিসাবে উৎপাদিত হয়। উপজাত দ্রব্যগুলি প্রায়ই প্রাথমিক পণ্যের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি হয়। তবে, কিছু উপজাত দ্রব্যের জন্য উল্লেখযোগ্য বাজার থাকতে পারে, বিশেষ করে যদি সেগুলি অন্যান্য পণ্যের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, তেল শোধনাগার থেকে প্রাপ্ত পেট্রোকেমিক্যাল উপজাত দ্রব্যগুলি প্লাস্টিক, রাসায়নিক এবং অন্যান্য পণ্যের জন্য কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
উপজাত দ্রব্যের প্রকারভেদ
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনের সময় কিছু অনিচ্ছাকৃত পদার্থের সৃষ্টি হয়। এগুলিকে উপজাত দ্রব্য বলে। এই উপজাত দ্রব্যগুলিকে আমরা বিভিন্ন ভাগে ভাগ করতে পারি।
প্রাথমিক উপজাত দ্রব্য:
প্রাথমিক উপজাত দ্রব্য হল সেইসব পদার্থ যা প্রধান পণ্য উৎপাদনের প্রাথমিক পর্যায়ে তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, চিনি উৎপাদনের সময় মল্যাস উৎপন্ন হয়, যা একটি প্রাথমিক উপজাত দ্রব্য।
পারিশ্রমিক উপজাত দ্রব্য:
পারিশ্রমিক উপজাত দ্রব্য হল সেগুলো যা প্রধান পণ্যকে আরও পরিশোধন বা প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় সৃষ্টি হয়। ধরুন, পেট্রোলিয়াম শোধনের সময় এলপিজি, ন্যাপথা ইত্যাদি উপজাত দ্রব্য হিসাবে পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় উপজাত দ্রব্য:
দ্বিতীয় উপজাত দ্রব্য হল সেগুলো যা প্রাথমিক বা পারিশ্রমিক উপজাত দ্রব্যের আরও প্রক্রিয়াকরণের ফলে তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইথানল উৎপাদনের সময় মেল্যাসের ফার্মেন্টেশন থেকে গ্লিসারিন একটি দ্বিতীয় উপজাত দ্রব্য।
অবশিষ্টাংশ:
অবশিষ্টাংশ হল সেইসব বর্জ্য পদার্থ যা প্রধান পণ্য উৎপাদনের সময় তৈরি হয় এবং সাধারণত কোনও মূল্য থাকে না। উদাহরণস্বরূপ, খনিজ তেল শোধনের সময় টার নামে একটি অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়।
এই ভাগসমূহের পাশাপাশি, উপজাত দ্রব্যগুলিকে আরও শক্ত, তরল এবং বায়বীয় উপজাত দ্রব্য হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে।
উপজাত দ্রব্যের উদাহরণ
উপজাত দ্রব্য হল এমন পদার্থ বা পণ্য যা প্রাথমিক উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে অতিরিক্ত হিসাবে প্রাপ্ত হয়। এগুলো প্রায়ই মূল পণ্যের তুলনায় কম মূল্যবান হয় এবং বিভিন্ন ব্যবহারের জন্য পুনর্ব্যবহৃত বা প্রক্রিয়াজাত করা যেতে পারে।
হল:
- কাঠের খই: এটি কাঠের করাতকরণ প্রক্রিয়ার একটি উপজাত দ্রব্য যা নির্মাণ উপকরণ, জ্বালানি এবং অন্যান্য পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
- গাভীর গোবর: এটি গবাদি পশু পালনের একটি উপজাত দ্রব্য যা সার এবং バイオガス উৎপাদনে ব্যবহৃত হতে পারে।
- মুড়ি খোল: এটি চাল মিল করার একটি উপজাত দ্রব্য যা পশুখাদ্য এবং জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
- টম্যাটোর বীজ: এটি টম্যাটোর প্রক্রিয়াজাতকরণের একটি উপজাত দ্রব্য যা নতুন টম্যাটো গাছ উৎপাদনে ব্যবহার করা যেতে পারে।
- কফির ভুসি: এটি কফির প্রক্রিয়াজাতকরণের একটি উপজাত দ্রব্য যা সার, জ্বালানি এবং পশুখাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
উপজাত দ্রব্যের ব্যবহার
সাধারণত, মূল্যবান পণ্য উৎপাদনের পরে অবশিষ্ট উপকরণ বা পদার্থকে উপজাত দ্রব্য বলে। এগুলি প্রায়শই বর্জ্য বা অবর্জনা হিসাবে বিবেচিত হয়, কিন্তু উপযুক্ত পুনর্ব্যবহার এবং নতুনত্বের মাধ্যমে, এগুলিকে মূল্যবান संसाधनोंে রূপান্তর করা যেতে পারে।
উপজাত দ্রব্যগুলি বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত হয়, যেমন:
- নির্মাণ: কাঠের গুঁড়া কংক্রিটে মিশ্রিত করা যেতে পারে এবং ইট এবং টাইলস তৈরি করতে ব্যবহৃত হতে পারে।
- চিকিৎসা: ফলের খোসা মূল্যবান পুষ্টি উপাদানসমূহ সমৃদ্ধ যা ওষুধ এবং পুষ্টি সম্পূরক তৈরিতে ব্যবহৃত হতে পারে।
- কৃষি: পশুর আবর্জনা জৈব সার হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে, যা মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং ফসলের উৎপাদন বাড়ায়।
- শক্তি: কাঠের গুঁড়া এবং অন্যান্য কৃষি বর্জ্য জ্বালানি উৎপাদন করতে ব্যবহৃত হতে পারে।
- পরিবেশ: প্লাস্টিকের বোতল পুনর্ব্যবহার করা যেতে পারে এবং নতুন পণ্যে রূপান্তরিত করা যেতে পারে, যা ল্যান্ডফিলগুলিতে বর্জ্যের পরিমাণ হ্রাস করে।
মূলত উপজাত দ্রব্যগুলির ব্যবহারে আমাদের অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক সুবিধা রয়েছে। এগুলি বর্জ্য হ্রাস করে, প্রাকৃতিক संसाধন সংরক্ষণ করে, এবং নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে। সৃজনশীলতা এবং নতুনত্বের মাধ্যমে, আমরা উপজাত দ্রব্যগুলিকে মূল্যবান संसाধनोंে রূপান্তর করতে পারি যা আমাদের জীবনকে উন্নত করবে এবং আমাদের গ্রহের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
উপজাত দ্রব্যের সুবিধা এবং অসুবিধা
উপজাত দ্রব্য হলো প্রধান পণ্য উৎপাদনের সময় পাওয়া গৌণ পণ্য। এগুলো প্রধান পণ্যের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি করা হয়। উপজাত দ্রব্যের কিছু সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে।
সুবিধা:
- উপজাত দ্রব্যগুলো উৎপাদন ব্যয় কমায়। কারণ, এগুলোর জন্য আলাদাভাবে কোনো কাঁচামাল কিনতে হয় না।
- এগুলো অতিরিক্ত আয়ের একটি উৎস।
- পরিবেশবান্ধব। কারণ, এগুলো বর্জ্য পদার্থের পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত হয়।
অসুবিধা:
- উপজাত দ্রব্যগুলো প্রধান পণ্যের গুণগত মান কমাতে পারে।
- এগুলোর বাজার মূল্য অনেক সময় অস্থির হয়।
- এগুলোর সরবরাহ প্রায়ই ঋতু বা অন্যান্য কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
সামগ্রিকভাবে, উপজাত দ্রব্য উৎপাদনকারীদের এবং পরিবেশের জন্য উপকারী হতে পারে। তবে, তাদের সম্ভাব্য অসুবিধাগুলো বিবেচনা করাও গুরুত্বপূর্ণ।