আপনি কি জানেন কত হিজরীতে বাংলা সন চালু হয়েছে?

আমরা বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের জাতীয় সন হিসেবে বাংলা সন ব্যবহার করি। তবে এই সনটির উৎপত্তি ও বর্তমান ব্যবহার সম্পর্কে অনেকেরই জানা নেই। এই ব্লগ পোস্টে আমরা বাংলা সনের পটভূমি, ইতিহাস, হিসাব পদ্ধতি এবং বর্তমানে এর ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

বাংলা সনটি একটি সৌর সন, যা সূর্যের গতির উপর ভিত্তি করে গণনা করা হয়। এটি মূলত হিজরি সন থেকে উদ্ভূত, যা একটি চান্দ্র সন এবং ইসলামী দেশগুলিতে ব্যবহৃত হয়। বাংলা সন হিজরি সনকে ভিত্তি করে তৈরি করা হলেও এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে, যা আমরা এই পোস্টে আলোচনা করব।

বাংলা সনের পটভূমি

মূলত বাংলা সন হচ্ছে একটি সৌর পঞ্জিকা, যা প্রাচীন ভারতের গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়ে উদ্ভূত হয়েছিল। এটি 315 খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রবর্তিত হয়েছিল। এই পঞ্জিকাটি প্রধানত বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা রাজ্যে ব্যবহৃত হয়।

বাংলা সনের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ, যা সাধারণত এপ্রিলের ১৪ তারিখের কাছাকাছি পড়ে। বাংলা সনে ১২টি মাস রয়েছে, যার প্রতিটি মাসে ৩০ বা ৩১ দিন থাকে। অতিরিক্ত দিনগুলি সমন্বয় করার জন্য প্রতি তিন বছরে একবার অতিরিক্ত একটি মাস যুক্ত করা হয়। এই অতিরিক্ত মাসটি অধিক মাস নামে পরিচিত এবং সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বর মাসে পড়ে।

বাংলা সন একটি সৌর পঞ্জিকা হওয়ায়, এটি পৃথিবীর সূর্যের চারপাশে ঘোরার চক্রের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি মাসের শুরু একটি নির্দিষ্ট নক্ষত্রের উদয়ের সাথে মিলে। বাংলা সনের নামকরণও নক্ষত্রদের নাম থেকে করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বৈশাখ মাসটি বিশাখা নক্ষত্রের উদয়ের সাথে শুরু হয়।

হিজরি সনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

হিজরি সন হচ্ছে ইসলামি বর্ষপঞ্জি, যা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঘটনার স্মরণে প্রবর্তিত হয়েছিল। এই ঘটনাটি ঘটেছিল ৬২২ খ্রিস্টাব্দে, যা হিজরি সনের শুরু বিন্দু হিসেবে বিবেচিত হয়।

মূলত হিজরি সন একটি চান্দ্র সৌর বর্ষপঞ্জি, যা চাঁদের গতির উপর ভিত্তি করে তৈরি। একটি হিজরি বছরে ৩৫৪ বা ৩৫৫টি দিন থাকে, যা সৌর বছরের চেয়ে ১১ দিন কম। এই কারণে, হিজরি সনের তারিখগুলি প্রতি বছর সৌর বর্ষের তারিখগুলির তুলনায় ১১ দিন পিছিয়ে যায়।

হিজরি সন মূলত ইসলামী দেশগুলোতে ব্যবহৃত হয় তবে এটি বিশ্বব্যাপী ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ধর্মের গবেষণায়ও ব্যবহৃত হয়। এটি মুসলিমদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উৎসব এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাপঞ্জির তারিখ নির্ধারণের জন্যও ব্যবহৃত হয়।

হিজরি সনে বাংলা সনের প্রবর্তন

আমাদের বাংলা সন হিজরি সন থেকে প্রবর্তিত হয়েছে। হিজরি সন হচ্ছে মুসলিমদের চন্দ্রভিত্তিক ক্যালেন্ডার, যা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ রেখে চালু করা হয়েছিল। হিজরতের ঘটনা ঘটেছিল ক্রিশ্চিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৬২২ খ্রিস্টাব্দে, এবং এই ঘটনাকে স্মরণ রেখে হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম বছর হিসেবে গণ্য করা হয়।

আমাদের বাংলা সন হিজরি সনের ৫৯৪ সালের ১০ই কার্তিক থেকে চালু করা হয়। এই সময় বাংলার ক্ষমতাসীন শাসক ছিলেন সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ। তিনি বাংলায় একটি স্বতন্ত্র সন প্রবর্তনের জন্য হিজরি সনকে ভিত্তি হিসেবে নিয়েছিলেন। এই বাংলা সন শুরু হয় বসন্তকালের শুরুতে, যা হিন্দুদের পবিত্র উৎসব নববর্ষের সঙ্গে মিলে যায়।

বাংলা সনের প্রতিটি মাসই ৩০ দিনের হয়, এবং বছরের ষষ্ঠ মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যুক্ত করা হয় যাকে ‘মলমাস’ বলা হয়। মলমাসটি বাংলা সনের আয়নকাল অনুযায়ী প্রায় প্রতি তিন বছরে একবার যুক্ত করা হয়। বাংলা সনের মাসগুলো হল: বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র।

এইভাবে, আমাদের বাংলা সন হিজরি সনের ৫৯৪ সাল থেকে চালু হওয়া একটি স্বতন্ত্র সন, যা বাংলাদেশের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা রাজ্যে ব্যবহৃত হয়।

প্রবর্তনের কারণ এবং প্রেক্ষাপট

আমাদের দেশের বর্তমানে যে বাংলা সন পঞ্জিকা ব্যবহৃত হয়, তার প্রচলন হয় মূলত ১৫৫৬ সালে তৎকালীন বাদশাহ আকবরের আমলে। সেই সময়ের জ্যোতির্বিদ ফতেহুল্লাহ শিরাজী বাংলাদেশের তদানীন্তন রাজধানী গৌড়ে সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থের ভিত্তিতে ক্যালেন্ডারটি প্রস্তুত করেন। তৎকালীন বাংলা বিহার ও উড়িষ্যা অঞ্চল শাসন করার সুবিধার্থে তিনি এই ক্যালেন্ডারটি প্রস্তুত করেন। বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রবর্তনের আগ পর্যন্ত, এই অঞ্চলে সৌর ও চান্দ্র দুটি পঞ্জিকাই প্রচলিত ছিল। তবে, বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রবর্তনের ফলে এই অঞ্চল একটি নির্দিষ্ট ও সর্বজনীন পঞ্জিকার আওতায় আসে, যা শাসনকার্য ও ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক সুবিধা এনে দেয়।

বাংলা সনের হিসাব পদ্ধতি

বাঙালিদের নিজস্ব সন হিসাব পদ্ধতি রয়েছে যা বাংলা সন নামেও পরিচিত। এই সন পদ্ধতি প্রচলিত খ্রীষ্টীয় সনের চেয়ে প্রায় ৫৯৪ বছর পুরনো। কিন্তু তুমি কি জানো বাংলা সন কত হিজরীতে চালু হয়েছিল?

বাংলা সন চালু হয়েছে হিজরী সনের সূচনা থেকেই। ইসলামী পঞ্জিকা অনুযায়ী, ৬২২ খ্রীষ্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিজরী সন গণনা শুরু হয়। সেই হিসেবে, বাংলা সন চালু হয়েছে হিজরী সন ১-এ। তবে সেই সময় বাংলা সনকে ‘শকাব্দ’ নামে ডাকা হতো।

শকাব্দ হিসাব পদ্ধতি খ্রীষ্টীয় সনের ৭৮ সাল থেকে শুরু হয়। আর বাংলা সন শুরু হয়েছে শকাব্দ ৫৯৪ সাল থেকে। অর্থাৎ, খ্রীষ্টীয় সনের ৬২২ সালে হিজরী সনের সূচনা ঘটে এবং সেই একই বছরেই বাংলা শকাব্দ হিসাব পদ্ধতি চালু হয়। তবে বর্তমান বাংলা সন হিসাব পদ্ধতি ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে চালু হয়। এই সন পদ্ধতির প্রথম বছর ছিল বাংলা সন ৯৬৩।

বর্তমানে বাংলা সনের ব্যবহার

বাংলা সনের উৎপত্তি সম্বন্ধে বেশ কয়েকটি মত রয়েছে। একটি মত অনুসারে, ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে ফখর উদ্দিন মুবারক শাহ নামক এক সুলতান বঙ্গদেশে বাংলা সন চালু করেন। কথিত আছে, তিনি হিজরী সনের ৯৬৩ হিজরীকে বাংলা সনের প্রথম বছর হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এর কারণ, ৯৬৩ হিজরীতে সুলতানের পুত্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি এই ঘটনাকে স্মরণে রাখার জন্য এই সন চালু করেছিলেন।

আরেকটি মত অনুসারে, বাংলা সন চালু করেছিলেন রাজা গণেশ। তিনি ছিলেন বঙ্গদেশের মল্ল বংশের একজন রাজা। তিনি ৯১৮ হিজরী সালকে বাংলা সনের প্রথম বছর হিসাবে গণ্য করেছিলেন। কারণ, ৯১৮ হিজরীতে তিনি কাশীমবাজারে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন।

এ ছাড়াও আরো কিছু মত রয়েছে বাংলা সনের উৎপত্তি নিয়ে। তবে কোন মতটি সঠিক তা নিয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। তবে সবচেয়ে প্রচলিত মতটি হলো বাংলা সন চালু করেছিলেন ফখর উদ্দিন মুবারক শাহ।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *