পাকিস্তানের সৃষ্টির পেছনে অসম্ভব প্রস্তাবগুলি

পাকিস্তানের সৃষ্টি হলো গত শতাব্দীর অন্যতম প্রধান ঘটনা। ভারতবর্ষের বিভক্তি ও পাকিস্তানের জন্মের পেছনে এক দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস রয়েছে। আমি সেই ইতিহাসের খুঁটিনাটি বিষয়গুলি আপনাদের সামনে তুলে ধরব, যা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির পটভূমি বুঝতে সাহায্য করবে। এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবে বিভিন্ন প্রস্তাব এবং পরিকল্পনা, যেমন লাহোর প্রস্তাব, কাবিরেজ প্রস্তাব, ওয়েভেল পরিকল্পনা, সিমলা সম্মেলন এবং ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা।

এই ঘটনাগুলির একটি কালানুক্রমিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে, আমরা বুঝতে পারব কীভাবে ভারতের মুসলমানরা একটি পৃথক মাতৃভূমির দাবি করার পক্ষে তাদের অবস্থান জোরদার করেছিল এবং এই দাবির প্রতি প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল অন্যদের। পাকিস্তানের সৃষ্টির এই ইতিহাস আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝতেও সাহায্য করবে।

পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পটভূমি

বুঝতে হলে, আমাদের তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পূর্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে দেশভাগ নিয়ে চরম মতভেদ চলছিল। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম লীগ প্রথমবারের মতো স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি তোলে। তবে কংগ্রেস এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে একটি ঐক্যবদ্ধ ভারতের পক্ষে অবস্থান নেয়।

এই দ্বন্দ্বের ফলে ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়, যাতে ভারতকে দুটি স্বাধীন দেশ – ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত করার প্রস্তাব করা হয়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলি পাকিস্তানে যোগদান করবে, এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলি ভারতে থাকবে। এইভাবে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর প্রথম গভর্নর জেনারেল হন।

লাহোর প্রস্তাব (1940)

হলো একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব যা ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে একীভূত করে একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানায়। এই প্রস্তাবটি মুসলিম লীগ কর্তৃক 23 মার্চ, 1940 সালে লাহোরের মিন্টো পার্কে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে গৃহীত হয়।

প্রস্তাবটিতে ভারতীয় রাজ্যকে তিনটি দলে বিভক্ত করার দাবি করা হয়েছিল: উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল, একটি মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠন করবে; দক্ষিণ ভারতে হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল, একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে থাকবে; এবং দুটি অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত অঞ্চল, যেখানে উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরা একসাথে বাস করবে এবং তাদের নিজস্ব ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

লাহোর প্রস্তাবটি মুসলিম লীগের দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল, যা বিশ্বাস করে যে মুসলমান এবং হিন্দুরা দুটি আলাদা জাতি এবং তাদের পৃথক রাষ্ট্র থাকা উচিত। এই প্রস্তাবটি ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতাদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়, যারা একটি একীভূত ভারত চেয়েছিলেন।

কাবিরেজ প্রস্তাব (1944)

১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে, মুসলিম লীগের নেতা আবুল হাশিম প্রস্তাব করেন যে, ভারতের উত্তর-পূর্বে এবং উত্তর-পশ্চিমে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলিকে একটি পৃথক, স্ব-শাসিত মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে গঠন করা উচিত। এই প্রস্তাবটি কাবিরেজ প্রস্তাব নামে পরিচিত।

কাবিরেজ প্রস্তাবটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমদের জন্য একটি স্বাধীন এবং সুরক্ষিত রাষ্ট্র তৈরি করা। প্রস্তাবটি অনুযায়ী, এই মুসলিম রাষ্ট্রটি পাকিস্তান নামে পরিচিত হবে এবং এটি ভারতের উত্তর-পূর্বের বেঙ্গল, আসাম এবং সিলেট এবং উত্তর-পশ্চিমের পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (এনডাব্লিউএফপি) এবং কাশ্মীর নিয়ে গঠিত হবে।

কাবিরেজ প্রস্তাবটি ভারতীয় রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল এবং এটি মুসলিম লীগের দুই জাতির তত্ত্বের বাস্তব অভিব্যক্তি ছিল। এই তত্ত্বটি দাবি করে যে, হিন্দু এবং মুসলমান দুটি পৃথক জাতি এবং তারা একসাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে না। কাবিরেজ প্রস্তাবটি ভারতের ভবিষ্যতকে আকৃতি দিয়েছিল এবং অবশেষে ১৯৪৭ সালে ভারতের বিভাজন এবং পাকিস্তানের সৃষ্টিতে অবদান রেখেছিল।

ওয়েভেল পরিকল্পনা (1945)

ভারতে ব্রিটিশ শাসন শেষ করার জন্য ওয়েভেল পরিকল্পনা একটি প্রস্তাব ছিল। ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ওয়েভেল ১৯৪৫ সালে এই পরিকল্পনাটি প্রস্তাব করেছিলেন। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল ভারতকে একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে গঠন করা এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের দাবি মেটানো।

ওয়েভেল পরিকল্পনাটি ভারতকে একটি দমনমূলক কেন্দ্রশাসিত সরকারের অধীনে একটি সংহত ভারত হিসাবে রাখার প্রস্তাব করেছিল। এই পরিকল্পনাটি প্রদেশগুলিকে তাদের নিজস্ব সংবিধান তৈরি করার অনুমতি দেবে এবং তারা একটি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে একত্রিত হবে। কেন্দ্রীয় সরকারটি প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয় এবং অর্থনীতির মতো কয়েকটি বিষয়ের দায়িত্বে থাকবে।

পরিকল্পনাটি কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয়েরই সমালোচনার মুখে পড়ে। কংগ্রেস পরিকল্পনাটিকে ভারতের বিভাজন হিসাবে দেখেছিল। অন্যদিকে, মুসলিম লীগ পরিকল্পনাটিকে ভারতের মুসলিমদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট দূরগামী মনে করেনি।

ওয়েভেল পরিকল্পনাটি অবশেষে ব্যর্থ হয় এবং ১৯৪৭ সালে ভারত ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন দেশে বিভক্ত হয়ে যায়।

সিমলা সম্মেলন (1945)

সিমলা সম্মেলনটি ১৯৪৫ সালের ২৫ জুন থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত ভারতের সিমলায় অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনা এবং দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করাই ছিল এই সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য। এই সম্মেলনে ব্রিটিশ সরকার, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

সম্মেলনের প্রধান ফলাফলের মধ্যে একটি ছিল ভারতীয় সংবিধান রচনার জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন পরিষদের গঠন। এই পরিষদে হিন্দু, মুসলিম এবং শিখসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সম্মেলনে মুসলিম লীগের দাবি অনুযায়ী পাকিস্তানের দাবির প্রস্তাবটিও আলোচনা করা হয়। তবে, কংগ্রেস এই প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে এবং একটি ঐক্যবদ্ধ ভারতের পক্ষে সমর্থন প্রকাশ করে।

সিমলা সম্মেলন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল। এটি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলোচনা এবং समझौতার একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদান করেছিল। যদিও সম্মেলন পাকিস্তানের দাবির মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সমাধান করতে পারেনি, তবুও এটি ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার পথ সুগম করেছিল এবং দেশের স্বাধীনতা অর্জনে অন্যতম ধাপ ছিল।

ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা (1946)

এই সপ্তাহের সভাটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নথির দিকে নজর দেবে যা ভারতের বিভাজনে ভূমিকা রেখেছিল। ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনাটি 1946 সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভারতের সাংবিধানিক ভবিষ্যত নির্ধারণের জন্য প্রস্তাবিত একটি পরিকল্পনা ছিল। পরিকল্পনাটি ভারতকে একটি সংঘের রূপে গঠন করার প্রস্তাব করেছিল, যা ভারতের দুইটি প্রধান রাজনৈতিক দল, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের দাবি মেটাতে তৈরি করা হয়েছিল। যদিও পরিকল্পনাটি পরবর্তীতে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল, কিন্তু এটি পাকিস্তানের সৃষ্টিতে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।

ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা মূলত লেখা হয়েছিল ভারতের সাংবিধানিক ভবিষ্যত নির্ধারণের জন্য। যুদ্ধোত্তর বিশ্বে ভারতের ভূমিকা নিয়ে ব্রিটিশ সরকার উদ্বিগ্ন ছিল এবং তারা ভারতকে একটি স্থিতিশীল এবং গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে দেখতে চেয়েছিল। পরিকল্পনাটি ভারতকে একটি সংঘের রূপে গঠন করার প্রস্তাব করেছিল, যা প্রদেশগুলির একটি সংগঠন হবে যাদের নিজস্ব সরকার থাকবে। সংঘের একটি কেন্দ্রীয় সরকারও থাকবে যা প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয় এবং যোগাযোগের মতো বিষয়গুলির জন্য দায়ী হবে।

পরিকল্পনাটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দ্বারা ব্যাপকভাবে সমর্থন পেয়েছিল। কংগ্রেস মনে করেছিল যে পরিকল্পনাটি ভারতকে একটি স্থিতিশীল এবং গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে দেখার একটি উপায় প্রদান করবে। অন্যদিকে, মুসলিম লীগ পরিকল্পনাটির বিরোধিতা করেছিল। মুসলিম লীগ মনে করেছিল যে, পরিকল্পনাটি হিন্দুদের উপর মুসলমানদের সংখ্যালঘু হওয়ার বিষয়টি উপেক্ষা করেছিল এবং এটি মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবি পূরণ করবে না।

ব্রিটিশ সরকার ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল। যাইহোক, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে অচলাবস্থা ছিল। অবশেষে, ব্রিটিশ সরকার 1947 সালে ভারতীয় উপমহাদেশকে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়: ভারত এবং পাকিস্তান।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *