নবিদের পেশা: তাদের জীবনবৃত্তান্তে লুকিয়ে থাকা গোপন কাহিনী
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে পৃথিবীতে খলিফা হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আমাদের প্রত্যেকের জন্যই আল্লাহর পক্ষ হতে একটি নির্দিষ্ট দায়িত্ব বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে মূলতঃ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আমাদের জীবিকা নির্বাহের জন্যও কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। তবে আল্লাহর নবী-রাসুলগণ কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করতেন তা কি কখনও ভেবে দেখেছেন? হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত আল্লাহর সব নবী-রাসুলের জীবিকা নির্বাহের পদ্ধতি খুবই সাদামাটা ছিল। তাঁদের কারোরই জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য কোনো কাজ করার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের সকলেরই একটি করে পেশা ছিল। আজকের আলোচনায় আমরা পূর্বের নবীদের পেশা সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। তাঁরা কি পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, তাঁদের জীবিকা নির্বাহের উপায়ই বা কী ছিল, সে সম্পর্কে আজ বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
পূর্বেকার নবীদের সাধারণ পেশা
আল-কুরআন এবং ইতিহাস থেকে জানা যায়, পূর্বেকার নবীগণ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এসব পেশা ছিল তাদের মুখ্য জীবিকার উৎস এবং নবুয়তের দায়িত্ব পালনের সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ, হজরত ইদ্রিস (আ.)-এর পেশা ছিল দর্জি, হজরত সালেহ (আ.) ছিলেন উট পালনকারী, হজরত শুয়াইব (আ.) ছিলেন গোয়াল, হজরত মুসা (আ.) ছিলেন মেষপালক, হজরত জাকারিয়া (আ.) ছিলেন সুতার এবং হজরত হারুন (আ.) ছিলেন স্বর্ণকার। এছাড়াও, হজরত দাউদ (আ.) ছিলেন অস্ত্রশাস্ত্র তৈরির কারিগর, হজরত সুলায়মান (আ.) ছিলেন ধাতুবিদ্যাবিদ এবং হজরত হুদ (আ.) ছিলেন মৃৎশিল্পী। এই পেশাগুলো তাদের নবুয়তের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করেছে। যেমন, হজরত ইদ্রিস (আ.) দর্জি হিসেবে সূচ ও সুতা ব্যবহার করে মানুষের কাপড় তৈরি করে তাদের প্রয়োজন পূরণ করতেন। হজরত শুয়াইব (আ.) গোয়াল হিসেবে গবাদি পশু পালন করে মানুষের দুধ, মাংস ও অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা পূরণ করতেন। তাই, পূর্বেকার নবীগণ সাধারণ জনগণের মতোই বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, যা তাদের নবুয়তের কাজকে সহজ করেছে এবং তাদের অনুসারীদের জন্য আদর্শ হয়ে রয়েছে।
হযরত আদম (আ.)-এর পেশা
নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। কোনো কোনো আলেম বলেন, তিনি ছিলেন একজন কৃষক। আবার অন্যদের মতে, তিনি ছিলেন একজন মালী। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতটি হলো, হযরত আদম (আ.) ছিলেন একজন শিক্ষক। তিনি তার সন্তানদের ও সমজদার প্রাণীদের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন ধরনের পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণ দিতেন। তিনি গঠন করেছিলেন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা, যা পরবর্তী যুগে অনেকটাই বিকশিত হয়েছে। তাই বলা যায়, হযরত আদম (আ.) ছিলেন একজন পেশাদার শিক্ষক।
হযরত দাউদ (আ.)-এর পেশা
যেমনটি কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি একজন লোহারকামী ছিলেন। লোহার কামার হিসেবে দাউদ (আ.) অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। তিনি অসাধারন অস্ত্র ও অলঙ্কার তৈরি করতে পারতেন।
কারণে তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। তার অস্ত্রগুলি যোদ্ধাদের মধ্যে খুব কদর করা হত এবং তার অলঙ্কারগুলি উচ্চ শ্রেণির মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। দাউদ (আ.)-এর পেশাও তাকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সামাজিক মর্যাদা প্রদান করেছিল।
তার পেশার পাশাপাশি, হযরত দাউদ (আ.) একজন নবী ছিলেন যিনি আল্লাহর বাণী প্রচার করার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তার সঙ্গীত ও কবিতার জন্যও পরিচিত ছিলেন, যা তিনি আল্লাহর প্রশংসা এবং মানুষের পথ প্রদর্শন করতে ব্যবহার করতেন।
হযরত ইউসুফ (আ.)-এর পেশা
নিয়ে ইসলামি গ্রন্থের বিভিন্ন সূরা ও আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সূরা ইউসুফের বর্ণনা অনুযায়ী, ইউসুফ (আ.) ছিলেন একজন স্বপ্ন দোভাষী ও মিসরের রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। তিনি ফিরআউনের রাজ্যে বনী ইসরাইলের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর পিতা হযরত يعকুব (আ.) তাকে তার অপর সহোদরদের সাথে মিসরে খাবার আনতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু যুদার পরামর্শ অনুযায়ী তার সহোদররা তাকে মিসরের দাস বাজারে বিক্রি করে দেয়। সেখান থেকে তাকে মিসরের রাজকোষাধ্যক্ষ আজিজ কিনে নেন। আজিজের স্ত্রীর অপবাদ এবং সততার কারণে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। কারাগারে তিনি ফিরআউনের দুই কর্মকর্তার স্বপ্ন দোভাষ করেন। তাঁর দোভাষের সঠিকতা দেখে ফিরআউন তাকে ডেকে পাঠান। তিনিই ফিরআউনের স্বপ্নের সঠিক দোভাষ করেন এবং মিসরের রাজ্যের অর্থমন্ত্রী হন।
হযরত মূসা (আ.)-এর পেশা
আপনার জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে, আসুন আমরা হযরত মূসা (আ.)-এর জীবন ও পেশা সম্পর্কে আলোচনা করি।
হযরত মূসা (আ.) একজন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী নবী ছিলেন, যিনি প্রাচীন মিসর ও মধ্যপ্রাচ্যের দাসত্ব ও উৎপীড়নের সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। যদিও তাঁর জীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন পেশা অবলম্বন করেছেন, তবে তাঁর প্রাথমিক পেশা ছিল একজন চরবাহক।
বাল্যকালে তিনি মিসরের রাজকন্যার একজন গোপন দাস ছিলেন। যখন তিনি বয়ঃপ্রাপ্ত হন, তিনি ফারাওয়ের রাজসভায় প্রবেশ করেন, কিন্তু দ্রুতই নিষ্পেষিত দাসদের দুর্দশার জন্য দুঃখিত হয়ে পড়েন। এক দিন, তিনি একজন ইস্রায়েলি দাসকে মিসরীয় কর্মকর্তার কাছ থেকে রক্ষা করেন, যার ফলে তিনি ফারাওয়ের ক্রোধের মুখে পড়েন।
আত্মরক্ষার জন্য, মূসা (আ.) মিসর ছেড়ে মিদিয়ান নামক দেশে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি শুয়্যিব নামে একজন পুরোহিতের প্রধান চরবাহক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। তিনি দশ বছর শুয়্যিবের জন্য চরান করেন, এই সময়ের মধ্যে তিনি তাদের মেয়ে সফুরাকে বিয়ে করেন এবং তাদের দুটি সন্তান হয়।
তার চরবাহক পেশা ছিল সত্তার সাথে তাঁর সংযোগের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। তুর সিনায় একটি জ্বলন্ত জলন্ত বুশের মধ্যে তিনি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাঁকে ইস্রায়েলীদের মুক্ত করার জন্য মিসরে ফিরে যেতে বলা হয়। এই মহান দায়িত্ব গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হওয়ার জন্য দশ বছরের চরবাহকের জীবন তাঁকে অত্যন্ত দরকারী দক্ষতা প্রদান করেছিল।
তাই, হযরত মূসা (আ.)-এর প্রাথমিক পেশা ছিল একজন চরবাহক, যা তাঁর জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করেছিল।
হযরত সুলায়মান (আ.)-এর পেশা
হযরত সুলায়মান (আ.) ছিলেন আল্লাহর এক প্রিয় নবি ও ইহুদি ও মুসলিম সভ্যতার একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে সিংহাসনে বসেন তার পিতা দাউদ (আ.)-এর মৃত্যুর পর।
সুলায়মান (আ.)-এর পেশাকে लेकर মতান্তর রয়েছে। কিছু মতে, তিনি ছিলেন একজন সরকারি কর্মচারী, কেউ কেউ মনে করেন তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী, আবার অন্য কেউ বলেন তিনি ছিলেন একজন রাখাল। তবে সবচেয়ে প্রচলিত মত হল তিনি ছিলেন একজন কৃষক।
কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে, “আমি তোমাকে (সুলায়মান) প্রচুর ধন-সম্পদ ও রাজত্ব দিয়েছি, যা তোমার পূর্বেকারদের কারও দেইনি।” (সুরা সাদ: ৩৪)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে সুলায়মান (আ.) কৃষিজীবী ছিলেন। কৃষিতে তিনি ছিলেন নিপুণ তথা একজন সফল কৃষক। তিনি বিশাল পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন করেছিলেন এবং তার জনগণের মধ্যে তা বিতরণ করেছিলেন।
হযরত সুলায়মান (আ.)-এর কৃষিজীবন আমাদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা। এটি আমাদের শেখায় যে, আমাদের সবচেয়ে সাধারণ কাজও পবিত্র হতে পারে। যদি আমরা আমাদের কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করি, তবে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।