ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের করণীয় কী? মারাত্মক ডেঙ্গু ভাইরাস হতে বাঁচার উপায়
আমাদের দেশে, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, বমি এবং ডায়রিয়া হচ্ছে এর প্রধান উপসর্গ। তবে, অনেক সময় এর উপসর্গগুলো লুকিয়েও থাকতে পারে অথবা অন্য রোগের অনুরূপও হতে পারে। এ কারণে কখনও কখনও ডেঙ্গু রোগ নির্ণয় করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এই রোগটি মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। তাই, ডেঙ্গু মশার জীবনচক্র এবং প্রজনন প্রক্রিয়া জানা আমাদের জন্য খুবই জরুরি।
আজকের এই আর্টিকেলে ডেঙ্গুর বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হবে। আমরা জানবো ডেঙ্গু কী, এর উপসর্গগুলো কী, কীভাবে এই রোগটি ছড়ায়, সরকার ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং আমরা কীভাবে এই মারাত্মক রোগটি থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারি। শুধু তা-ই নয়, কোনও ব্যক্তির ডেঙ্গু হয়েছে বলে নিশ্চিত হলে কী করণীয় সে সম্পর্কেও আলোচনা করা হবে।
ডেঙ্গু কি?
ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাল সংক্রমণ যা ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা ঘটে। এই ভাইরাসটি এডিস মশা দ্বারা ছড়ায়। ডেঙ্গুর লক্ষণগুলি সাধারণত সংক্রমণের ৪-১০ দিন পরে শুরু হয় এবং এতে জ্বর, মাথাব্যথা, পেশী ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা, বমিভাব এবং ত্বকে র্যাশ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। গুরুতর ক্ষেত্রে, ডেঙ্গু ডেঙ্গু রক্তক্ষরণ জ্বর (ডিএইচএফ) বা ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম (ডিএসএস) এর কারণ হতে পারে, যা মারাত্মক হতে পারে।
মূলত ডেঙ্গু হওয়ার ঝুঁকি কমাতে এবং এর বিস্তার রোধ করতে, ডেঙ্গু মশাদের নিয়ন্ত্রণ এবং নিজেকে মশার কামড় থেকে রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিশ্চিত কর путем যে আপনার বাড়ির আশেপাশে কোনো স্থির জল নেই যেখানে মশা বংশবিস্তার করতে পারে, যেমন পুরানো টায়ার, ডাবা বা খোলা জলের পাত্র। এছাড়াও, যখন বাইরে যান তখন লম্বা হাতাওয়ালা শার্ট এবং প্যান্ট পরুন, মশার তেলে প্রতিবিষ ব্যবহার করুন এবং মশারি ব্যবহার করুন।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ
গুলি সম্পর্কে জানার জন্য, আমাদের প্রথমে ডেঙ্গু ভাইরাসের বিভিন্ন ধরন সম্পর্কে বুঝতে হবে। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন রয়েছে, যা DEN-1, DEN-2, DEN-3 এবং DEN-4 নামে পরিচিত। ডেঙ্গু ভাইরাসের কোন একটি ধরনে আক্রান্ত হলে রোগীর শরীরে প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরি হয়, ফলে পরে সেই ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু একই ব্যক্তি যদি দ্বিতীয়বার অন্য কোন ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তবে তার ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS) হওয়ার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায় এবং মৃত্যুও ঘটতে পারে।
ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর সাধারণত 4 থেকে 10 দিনের মধ্যে উপসর্গগুলি প্রকাশ পায়। এই উপসর্গগুলি একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। সাধারণ উপসর্গগুলি হল:
- হঠাৎ করেই তীব্র জ্বর
- মাথাব্যথা, বিশেষ করে চোখের পেছনে
- চোখের পেছনে ব্যথা
- পেশী ও জয়েন্টে ব্যথা
- বমি বমি ভাব এবং বমি
- ত্বকে র্যাশ হওয়া
- লিম্ফ নোডে ফোলাভাব
- ক্লান্তি এবং দুর্বলতা
ডেঙ্গু মশার জীবনচক্র এবং প্রজনন
এখানে ডেঙ্গু মশা, এডিস এজিপ্টি নামেও পরিচিত, একটি বিপজ্জনক কীট যা ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ায়। এই মশার জীবনচক্র চারটি প্রধান পর্যায়ে বিভক্ত: ডিম, লার্ভা, পিউপা এবং প্রাপ্তবয়স্ক।
ডিম: মাদা মশা পরিষ্কার পানিতে, যেমন বৃষ্টির পানি জমে থাকা পাত্র, ফুলদানি বা পুরানো টায়ারে প্রায় ১০০টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলি কালো রঙের এবং হকি পাকের মতো আকৃতির।
লার্ভা: ডিমগুলো ফুটে লার্ভা বের হয়, যাদেরকে সাধারণত ‘মশার কুঁচি’ বলা হয়। লার্ভাগুলি পানির পৃষ্ঠের কাছে ভেসে থাকে এবং অণুজীব, শেত্তলা এবং অন্যান্য জৈব পদার্থ খেয়ে বেড়ে ওঠে। লার্ভার পর্যায় প্রায় ৫-১৪ দিন স্থায়ী হয়।
পিউপা: লার্ভা তাদের বৃদ্ধির শেষ পর্যায়ে পিউপাতে পরিণত হয়। পিউপা একটি নিষ্ক্রিয় পর্যায় যেখানে মশা তার প্রাপ্তবয়স্ক রূপে রূপান্তরিত হয়। পিউপার পর্যায় প্রায় ৩-১০ দিন স্থায়ী হয়।
প্রাপ্তবয়স্ক: পিউপা থেকে উদিত মশা প্রাপ্তবয়স্ক হয়। প্রাপ্তবয়স্ক ডেঙ্গু মশা কালো রঙের এবং সাদা দাগযুক্ত সরু শরীর। মাদা মশা ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য মানুষের রক্ত খায়। প্রাপ্তবয়স্ক মশা সাধারণত ৭-১৪ দিন বেঁচে থাকে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারী পদক্ষেপ
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- সচেতনতা বৃদ্ধি: ডেঙ্গুর লক্ষণ, প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য সরকার মিডিয়া প্রচারণা, স্কুল এবং সম্প্রদায়ে অ্যাক্টিভিটি চালাচ্ছে।
- মশা নিয়ন্ত্রণ: সরকার পানি জমে থাকা এলাকায় কীটনাশক স্প্রে করছে, ড্রেন ঠিক করছে এবং মশারির বিতরণ করছে।
- রোগী ব্যবস্থাপনা: সরকার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিশেষ চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করেছে এবং রক্ত পরীক্ষা এবং চিকিৎসার জন্য বিনামূল্যে সুবিধা প্রদান করছে।
- গবেষনা ও উন্নয়ন: সরকার ডেঙ্গু রোগের টিকা এবং চিকিৎসার উপর গবেষণা ও উন্নয়নকে সমর্থন করছে।
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সাথে সহযোগিতা করছে ডেঙ্গু প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে।
এই পদক্ষেপগুলি ডেঙ্গু প্রতিরোধে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মশা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডেঙ্গু জ্বরের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। রোগী ব্যবস্থাপনা এবং গবেষণা ও উন্নয়ন প্রচেষ্টার ফলে ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর হারও কমেছে। সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টা ডেঙ্গুকে একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য হুমকি হিসাবে দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের করণীয়
ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ যা জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা এবং ক্লান্তির মতো লক্ষণ দেখা দেয়। ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য আমাদের কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
প্রথমত, আমাদের আশপাশ থেকে মশা দূর করতে হবে। এজন্য আমাদের পানি জমার জায়গা, যেমন টায়ার, বালতি এবং ফ্লাওয়ারপট পরিষ্কার রাখতে হবে। এছাড়াও, বাড়ির আশেপাশে খোলা ড্রেনেজ সংস্কার করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের মশারি ব্যবহার করতে হবে। ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা মশাদের কামড় থেকে রক্ষা পেতে সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
তৃতীয়ত, আমাদের লম্বা হাতা-পা জামা পরতে হবে। এটি মশাদের কামড় থেকে আমাদের ত্বককে সুরক্ষা করবে।
চতুর্থত, আমাদের ডেঙ্গু ভ্যাকসিন নিতে হবে। ডেঙ্গু ভ্যাকসিন ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর উপায়। এটি ডেঙ্গু জ্বরের ঝুঁকি কমায়।
পঞ্চমত, আমাদের ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে। ডেঙ্গু একটি গুরুতর রোগ হতে পারে এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে জটিলতা হতে পারে।
আপনিও এই পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারেন। মনে রাখবেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধ আমাদের সবার দায়িত্ব।
নিশ্চিত হওয়া ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে করণীয়
ডেঙ্গু একটি মারাত্মক জ্বর যা এডিস মশার কামড়ে হয়। এই মশা সাধারণত সকাল ও সন্ধ্যায় সক্রিয় থাকে। ডেঙ্গু হলে প্রচণ্ড জ্বর, মাথাব্যথা, মাংসপেশী ও হাড়ের ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, বমি-পাতলা, লালচে ফুসকুড়ি, রক্তক্ষরণ ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। এর প্রকোপ বেশি হলে ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম হতে পারে যা মারাত্মক।
ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এডিস মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করা। এর জন্য নিচের কাজগুলো করতে হবে:
- ঘরের আশপাশে জমে থাকা পানি অপসারণ করা।
- টায়ার, পাত্র, বালতি ইত্যাদিতে পানি जमे ना रखें।
- ছাদ, বারান্দা, গাছের গোড়ায় জমে থাকা পানি পরিষ্কার করা।
- কুলার, এসি, রেফ্রিজারেটরের পানি নিয়মিত বদল করা।
- পানি জমতে পারে এমন জায়গায় ব্লীচিং পাউডার বা লবণ ছিটিয়ে দেওয়া।
- শরীর ঢেকে রাখার মতো পোশাক পরা।
- মশারির ভেতর ঘুমানো।
- ঘরে মশার কয়েল বা রিপেলেন্ট ব্যবহার করা।
এছাড়াও ডেঙ্গুর টিকা নেয়াও ডেঙ্গু প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গু টিকা দুই ডোজে নিতে হয়। প্রথম ডোজ নেয়ার ৯ থেকে ১২ মাস পরে দ্বিতীয় ডোজ নিতে হয়। ডেঙ্গু টিকা সাধারণত ৯০% পর্যন্ত ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সচেতনতা। আমরা যদি সচেতন থাকি এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায়গুলো অবলম্বন করি, তাহলে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব।