কাজী নজরুলের নিষিদ্ধ গ্রন্থ: একটি তালিকা

কবিতার রাজা কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁর ভাবনার সাহসিকতা ও মুক্তচিন্তার জন্য তাঁকে গ্রেফতার ও নির্যাতনও সহ্য করতে হয়েছে। এমনকি তাঁর কিছু বইও নিষিদ্ধ হয়েছিল। তাই আজ আমরা জানবো কাজী নজরুল ইসলামের নিষিদ্ধ গ্রন্থ সম্পর্কে।

এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারব কতগুলো গ্রন্থ নিষিদ্ধ হয়েছিল, প্রথম নিষিদ্ধ গ্রন্থটি কোনটি ছিল এবং কেন তা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এছাড়াও আমরা জানতে পারব ‘বিষের বাঁশি’ ও ‘পথের দাবি’ গ্রন্থদ্বয় নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ, ‘ডাকাত’ এবং ‘শিশু’ গ্রন্থ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ। আমার বিশ্বাস এই আলোচনা আপনাদের কাছে আকর্ষণীয় ও তথ্যবহুল হবে।

কাজী নজরুলের নিষিদ্ধ গ্রন্থের সংখ্যা

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের একজন কিংবদন্তি কবি, যার তীক্ষ্ণ কবিতা এবং বিপ্লবী লেখার জন্য ব্যাপকভাবে পরিচিত। তাঁর সাহিত্যকর্ম তাঁর জীবদ্দশায় অনেক বিতর্ক এবং সেন্সরশিপের সাক্ষী হয়েছে। কাজী নজরুলের কতগুলো গ্রন্থ নিষিদ্ধ হয়েছিল এবং কী কারণে তা নিয়ে আজ আমরা জানব।

নজরুলের সবচেয়ে বিখ্যাত নিষিদ্ধ কাজ হল “বিষের বাঁশি”। ১৯২২ সালে প্রকাশিত এই কবিতার সংগ্রহে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ এবং সামাজিক বিচারহীনতার নিন্দা রয়েছে। এই কবিতাগুলি তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছে এতটাই আপত্তিকর ছিল যে তারা এটিকে নিষিদ্ধ করে।

নজরুলের অন্য একটি নিষিদ্ধ গ্রন্থ হল “পূরবের পুরুষ”। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি মুসলিম সমাজে প্রচলিত প্রথাগততা এবং রক্ষণশীলতার সমালোচনা করে। বইটি মুসলিম নেতাদের মধ্যে ব্যাপক বিরোধের সৃষ্টি করে এবং অবশেষে সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ করা হয়।

উল্লেখ্য, নজরুলের “অগ্নিবীণা” এবং “ঝড় ও ঝাড়” কাব্যগ্রন্থগুলিও কিছু সময়ের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এই কবিতাগুলির মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জ্বালাময় প্রতিবাদ এবং স্বাধীনতার দাবি রয়েছে।

কাজী নজরুলের গ্রন্থগুলি নিষিদ্ধ হওয়ার কারণগুলি বহুমুখী। কিছু গ্রন্থে তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলেছিলেন, অন্যগুলি সামাজিক সংস্কার এবং প্রথাগততার সমালোচনা করেছিল। এই লেখাগুলি তৎকালীন কর্তৃত্বের পক্ষে অস্বস্তিকর ছিল, যারা তাদের দমন করার চেষ্টা করেছিল।

যদিও নজরুলের কিছু গ্রন্থ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু তার লেখা জনগণের কাছে পৌঁছানো বন্ধ করা যায়নি। তার কবিতা এবং গান গোপনে প্রচার করা হয়েছিল এবং তার সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে বিপ্লব ঘটিয়েছে। আজ, নজরুলের নিষিদ্ধ গ্রন্থগুলি তাঁর সাহস, প্রতিবাদী মনোভাব এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের অটল বিশ্বাসের সাক্ষ্য বহন করে।

প্রথম নিষিদ্ধ গ্রন্থ: ‘আগুনের পরশমণি’

১৯২২ সালে প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের ‘আগুনের পরশমণি’ প্রথম বাংলা গ্রন্থ যা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রকাশনার মাত্র দুই দিন পরে গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। গ্রন্থে ব্যবহৃত বিপ্লবী ভাষা ও রাজনৈতিক প্রচারের কারণে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। গ্রন্থে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমালোচনা করা হয়েছিল এবং ভারতের স্বাধীনতার ডাক দেওয়া হয়েছিল।

এরপর কাজী নজরুল ইসলামের আরও তিনটি গ্রন্থ নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯২৩ সালে ‘বিষের বাঁশি’, ১৯২৫ সালে ‘পুরুষ’ এবং ১৯২৬ সালে ‘যুগবাণী’। এগুলোতেও বিপ্লবী মনোভাব ও ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনা পাওয়া যায়। এই নিষেধাজ্ঞাগুলি নজরুল ইসলামের সাহিত্যিক কর্মজীবনে একটি বড় বাধা সৃষ্টি করেছিল। তবে, নিষেধাজ্ঞাগুলির ফলে তার জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায় এবং তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন।

‘বিষের বাঁশি’ ও ‘পথের দাবি’ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার কবিগুরু। তাঁর অগ্নিমুখর কবিতা আর প্রতিবাদী সুর স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লবের সঞ্চার করেছিল। তবে, তাঁর সাহসী ও প্রতিবাদী কবিতার কারণে ব্রিটিশ সরকার তাঁর অনেক গ্রন্থ নিষিদ্ধ করে। এর মধ্যে অন্যতম দুটি গ্রন্থ হল ‘বিষের বাঁশি’ ও ‘পথের দাবি’।

‘বিষের বাঁশি’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। এই গ্রন্থে নজরুল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে উদাত্ত কণ্ঠে প্রতিবাদ জানান। তাঁর কবিতাগুলিতে জ্বলন্ত দেশপ্রেম, সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচারের ছবি ফুটে উঠেছিল। এই কারণে ব্রিটিশ সরকার গ্রন্থটিকে নিষিদ্ধ করে এবং নজরুলের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করে।

মামলা চলাকালীনই নজরুল ‘পথের দাবি’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন ১৯২৬ সালে। এই গ্রন্থও ব্রিটিশ সরকারবিরোধী কবিতা দিয়ে লেখা। এতে তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের ডাক দেন। তাঁর কবিতাগুলি ছিল শক্তিশালী এবং সরকারবিরোধী। এই কারণে ব্রিটিশ সরকার এই গ্রন্থটিকেও নিষিদ্ধ করে।

‘ডাকাত’ এবং ‘শিশু’ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ

অনেকেরই মনে হয় কাজী নজরুল ইসলামের শুধুমাত্র ‘ডাকাত’ এবং ‘শিশু’ বই দুটি নিষিদ্ধ হয়েছিল। তবে আসলে তা নয়। কাজী নজরুল ইসলামের মোট ৮টি গ্রন্থ নিষিদ্ধ হয়। সেগুলো হলো:

১। ডাকাত (১৯২৬)
২। অগ্নিবীণা (১৯২২)
৩। শিশু (১৯২২)
৪। বিষবৃক্ষ (১৯২১)
৫। পুনশ্চ (১৯২৫)
৬। বেদনার অগ্নিশিখা (১৯২২)
৭। বন্দীর বন্দনা (১৯২৬)
৮। চিত্রাঙ্গদা (১৯২৬)

এই গ্রন্থগুলোতে ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রকাশ ঘটেছিল। তাই ব্রিটিশ সরকার এই গ্রন্থগুলো নিষিদ্ধ করে। এই নিষিদ্ধকরণ কাজী নজরুল ইসলাম এবং বাংলা সাহিত্যে তার অবদানকে দমন করার একটি প্রচেষ্টা ছিল। তবে এই নিষেধাজ্ঞা তার সৃজনশীলতাকে থামাতে পারেনি। কাজী নজরুল ইসলাম নিষিদ্ধের মুখেও লিখে গেছেন অমর কবিতা, গান এবং প্রবন্ধ।

নজরুলের নিষিদ্ধ গ্রন্থ সমূহ

কাজী নজরুলের কবিতা, গান এবং সাহিত্যকর্ম তাঁকে বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য স্থান এনে দিয়েছে। তাঁর নির্ভীক চিন্তাধারা ও স্পষ্টবাদিতা তাঁর অনেক কাজকে সমালোচনা ও নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন করেছে। ব্রিটিশ শাসনামলে নজরুল সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবেও কাজ করতেন এবং তাঁর লেখাগুলোতে প্রায়শই স্বাধীনতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবি উঠত। এসব কারণে তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

নজরুলের নিষিদ্ধ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

  • যালিম সুলতান (১৯২১)
  • পুনশ্চ (১৯২২)
  • লেনিন (১৯২২)
  • আনারকলি (১৯২২)
  • পাগলের পাঁচালী (১৯২২)
  • মহিষাসুর মর্দিনী (১৯২২)
  • গুলিস্তান (১৯২৩)
  • জল গাছ (১৯২৩)

এই গ্রন্থগুলো ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কারণ এগুলোতে প্রকাশ্যে স্বাধীনতার দাবি, সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং ধর্মীয় রীতিনীতির সমালোচনা করা হয়েছিল। নজরুলের এই গ্রন্থগুলো নিষিদ্ধ করা হলেও তা তাঁর জনপ্রিয়তাকে কমাতে পারেনি। বরং, তা তাঁকে জনগণের কাছে আরও প্রিয় করে তুলেছে।

নিষেধাজ্ঞার প্রভাব এবং পরবর্তীকালের পরিস্থিতি

যে কোন কিছু নিষিদ্ধ করা হলে তা আরও বেশি আকাঙ্খিত হয়ে ওঠে, এই কথাটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রে। ব্রিটিশ সরকার, তাঁর কবিতা ও গানের বিপ্লবী চেতনার কারণে তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ নিষিদ্ধ করেছিল। এই নিষেধাজ্ঞাগুলি কেবল তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রচারকেই বাধাগ্রস্ত করে নি, পাশাপাশি তাঁর ভাবনা ও চিন্তাধারার প্রসারেও বাধা সৃষ্টি করেছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নজরুল ‘বিদ্রোহী’ ও ‘যুগবাণী’ সহ বেশ কয়েকটি কবিতা এবং গান রচনা করেন যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেয়। এই সাহিত্যকর্মগুলির কারণে তাঁকে ১৯২২ সালে গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁর গ্রন্থ ‘ধুমকেতু’ নিষিদ্ধ করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯২৪ সালে তাঁর আরেকটি গ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ও নিষিদ্ধ করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞাগুলির ফলে নজরুলের সাহিত্যকর্ম জনগণের কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে, তবে এগুলি তাঁর জনপ্রিয়তাকে দমন করতে পারেনি। বরং নিষেধাজ্ঞাগুলি তাঁর রচনাগুলিকে আরও আকাঙ্খিত করে তোলে এবং তাঁর ভাবনা-চিন্তার প্রতি আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেয়।

নিষেধাজ্ঞার পরবর্তীকালে, নজরুলের সাহিত্যকর্মগুলি জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। তাঁর কবিতা ও গানগুলি বিদ্রোহ, স্বাধীনতা ও মানবতাবাদের চেতনা বহন করে, যা তৎকালীন বাঙালি সমাজে অনুরণিত হয়েছিল। তাঁর সাহিত্যকর্মগুলি এখনও আজকের বাংলাদেশ এবং ভারতের মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *