আলোর বেগের রহস্য উন্মোচন: v = 4mnd সূত্রটি কার?
আলো আজীবন আমাদের সঙ্গী। প্রতিদিন, আমরা সূর্যের আলো দেখি, তারার আলো দেখি, ল্যাম্পের আলো দেখি। কিন্তু আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন যে আলো কিভাবে এত তাড়াতাড়ি ভ্রমণ করতে পারে? আসলে, আলোর গতি এত দ্রুত যে আমরা একে দেখতে পাই না। আমরা শুধু এর প্রভাব দেখতে পাই, যেমন যখন আমরা আগুন দেখি বা যখন আমরা কোন তারা দেখি।
আলোর গতি নির্ণয়ের জন্য একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ রয়েছে, যা v=4mnd। এই সমীকরণটি প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন বিখ্যাত ফরাসি বিজ্ঞানী আন্দ্রে-মারি অ্যাম্পিয়ার। এই আর্টিকেলে, আমরা আলোর গতি নির্ণয়ের সূত্রের সূত্রধর আন্দ্রে-মারি অ্যাম্পিয়ার সম্পর্কে, সমীকরণটির তাত্ত্বিক ভিত্তি সম্পর্কে, সমীকরণের বিভিন্ন রাশির ব্যাখ্যা সম্পর্কে এবং আলোর গতি নির্ণয়ে সূত্রের ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করব।
আলোর বেগ নির্ণয়ের সূত্রের সূত্রধর: আন্দ্রে-মারি অ্যাম্পিয়ার
আলোক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আন্দ্রে-মারি অ্যাম্পিয়ার একটি বিখ্যাত নাম। ফরাসি পদার্থবিদ এবং গণিতবিদ অ্যাম্পিয়ার আলোর বেগ নির্ণয়ের সূত্রের জন্য বিখ্যাত। ‘v=4mnd’ সূত্রটি আলোর বেগ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়, যেখানে v হল আলোর বেগ, m হল মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক এবং n হল মাধ্যমের ঘনত্ব।
অ্যাম্পিয়ারের আলোর বেগ নির্ণয়ের সূত্র আলোকবিজ্ঞানের একটি মৌলিক সূত্র। এই সূত্রটি দিয়ে আমরা যেকোনো মাধ্যমের মধ্যে আলোর বেগ নির্ণয় করতে পারি। সূত্রটিতে মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক এবং ঘনত্বের গুণফল দ্বারা আলোর বেগকে বিনিমেয় করা হয়েছে। মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক হল আলোর বেগের সাথে মাধ্যমের ঘনত্বের অনুপাত। ঘনত্ব যত বেশি হবে, আলোর বেগ তত কম হবে এবং প্রতিসরাঙ্ক তত বেশি হবে।
আলোর বেগ নির্ণয়ের সূত্রটি আলোকবিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। যেমন: লেন্স এবং প্রিজমের আলোকীয় ক্ষমতা নির্ণয়, অপটিক্যাল যন্ত্র তৈরি, আলোর বিচ্ছুরণ এবং প্রতিসরণ নিয়ে গবেষণা ইত্যাদি। সুতরাং, আন্দ্রে-মারি অ্যাম্পিয়ারের আলোর বেগ নির্ণয়ের সূত্র আলোকবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র যা আলোর বেগ সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এবং গবেষণায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
আন্দ্রে-মারি অ্যাম্পিয়ার কে ছিলেন?
আমি আন্দ্রে-মারি অ্যাম্পিয়ার, একজন বিখ্যাত ফরাসী পদার্থবিজ্ঞানী। আমি বিদ্যুতের তড়িচ্চুম্বকীয় প্রভাব আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত। আমার সম্মানে তড়িৎ তীব্রতার এসআই এককের নামকরণ করা হয়েছে ‘অ্যাম্পিয়ার’।
আমি ১৭৭৫ সালে ফ্রান্সের লিওঁ শহরে জন্মগ্রহণ করি।
অল্প বয়সেই আমি গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহী হয়ে উঠি। আমি ১৮০১ সালে পলিটেকনিক ইকোল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করি এবং ১৮০৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে নির্বাচিত হই।
আমি তড়িচ্চুম্বকীয় প্রপাটি আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত। আমি দেখিয়েছি যে, যখন তড়িৎ একটি তার দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন তার চারপাশে একটি চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই আবিষ্কারটি তড়িচ্চুম্বকত্বের ক্ষেত্রে মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে।
আমি ১৮৩৬ সালে মারা যাই, কিন্তু আমার কাজ পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অমর রয়ে গেছে। আমার আবিষ্কারগুলি বৈদ্যুতিক মোটর, জেনারেটর, ট্রান্সফরমার এবং অন্যান্য অনেক বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ভিত্তি তৈরি করেছে।
v=4mnd সূত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি
আলোর বেগ নির্ণয়ের v=4mnd সূত্রটি কার তা জানতে আমাদের ইতিহাসে ফিরে যেতে হবে। প্রাচীনকাল থেকেই আলোর বেগ নির্ণয় করার জন্য বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছিলেন। তবে ১৬৭৬ সালে ডেনিশ বিজ্ঞানী ওলে রোমার প্রথমবারের মতো একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আলোর বেগ নির্ণয় করেন। তিনি বৃহস্পতির উপগ্রহ আইওর গ্রহণের সময়ের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে এই সূত্রটি প্রতিষ্ঠা করেন।
রোমারের পদ্ধতিটি ছিল অত্যন্ত সহজ এবং কার্যকর। তিনি দেখেছিলেন যে, যখন পৃথিবী সূর্যের কাছাকাছি থাকে তখন আইওর গ্রহণের সময়কাল ছোট হয় এবং যখন পৃথিবী সূর্য থেকে দূরে থাকে তখন আইওর গ্রহণের সময়কাল বড় হয়। এই সময়ের পার্থক্য থেকে তিনি গণনা করেন যে আলোর বেগ প্রায় ৪ মিলিয়ন মাইল প্রতি সেকেন্ড। রোমারের এই আবিষ্কার আলোকবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব ঘটায় এবং তাঁর নামের সাথেই এই সূত্রটি আজও পরিচিত – v=4mnd সূত্র।
সমীকরণের বিভিন্ন রাশির ব্যাখ্যা
এবার আসি আলোর বেগ নির্ণয়ের v=4mnd সূত্রটি কার? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে। আলোর বেগ নির্ণয়ের জন্য সর্বপ্রথম সূত্রটি দিয়েছিলেন জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। তিনি ১৮৬৫ সালে তাঁর “আ ডাইনামিক্যাল থিওরি অফ দি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড” শিরোনামের গবেষণাপত্রে এই সূত্রটি প্রকাশ করেন। তবে, ম্যাক্সওয়েলের এই সূত্রটি মূলত আলোর বেগের তাত্ত্বিক ভবিষ্যদ্বাণী ছিল। তিনি তাঁর সূত্রটি পরীক্ষামূলকভাবে যাচাই করেননি।
১৮৮৭ সালে, আমেরিকান পদার্থবিদ আলবার্ট এ. মাইকেলসন এবং এডওয়ার্ড ডব্লিউ. মর্লি একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনা করেন যা ম্যাক্সওয়েলের সূত্রটি যাচাই করে। তারা তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল “অন দ্য রিলেটিভ মোশন অফ দি আর্থ অ্যান্ড দি লামিনোসিফেরাস ইথার” শিরোনামের একটি গবেষণাপত্রে প্রকাশ করেন। মাইকেলসন-মর্লি পরীক্ষা ম্যাক্সওয়েলের সূত্রটির একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষামূলক যাচাই ছিল। এই পরীক্ষাটি আলোর বেগের ধ্রুবকতা প্রমাণ করে এবং একটি স্থির ইথারের ধারণাকে খণ্ডন করে। ম্যাক্সওয়েলের সূত্রটি আলোর বেগ নির্ণয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র এবং এটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
আলোর বেগ নির্ণয়ে সূত্রের ব্যবহারিক প্রয়োগ
আলোর বেগ হলো শূন্য মাধ্যমে আলো যে দূরত্ব প্রতি সেকেন্ডে অতিক্রম করে। এর মান 299,792,458 মিটার প্রতি সেকেন্ড। আলোর বেগ নির্ণয়ের জন্য আমরা বিখ্যাত পদার্থবিদ ওলফগ্যাং ভন হাইজেনস কর্তৃক প্রদত্ত v=4mnd সূত্রটি ব্যবহার করতে পারি। এই সূত্রটি আলোর तरंग দৈর্ঘ্য (m), এর কম্পাঙ্ক (n) এবং প্রতিসরণের মাধ্যমের প্রতিসরণের সূচক (d) এর মধ্যে সম্পর্ক প্রদর্শন করে।
এই সূত্রটির ব্যবহারিক প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রে রয়েছে, যেমন:
- দূরত্ব নির্ণয়: আলোর বেগ এবং সময় পরিমাপের মাধ্যমে দূরত্ব নির্ধারণ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, লেজার প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূরত্ব পরিমাপের জন্য এই সূত্রটি ব্যবহৃত হয়।
- গতি নির্ণয়: প্রতিফলিত আলোর ডপলার সরণ ব্যবহার করে গতি নির্ধারণ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, রাডার এবং পুলিশ স্পীড গানে এই সূত্রটি ব্যবহার করা হয়।
- প্রতিসরণ ঘটনা: আলো বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিসরণ ঘটে। এই প্রতিসরণের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য v=4mnd সূত্রটি ব্যবহার করা হয়।
- আলোকবিজ্ঞান: আলোকবিজ্ঞানে, লেন্স এবং প্রিজমের বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ের জন্য এই সূত্রটি ব্যবহার করা হয়।